চাঁদপুর ভ্রমন করতে চান? তবে শুনুন

চাঁদপুর জেলার অবস্থানঃ


মেঘনা, ডাকাতিয়া, ধনাগোদা নদীর কোল জুড়ে ১৭০৪.০৬ বর্গ কিমি আয়তনের ঘন সবুজ ভূখন্ডের নাম চাঁদপুর। ঐতিহাসিক জে. এম. সেনগুপ্তের মতে, চাঁদরায়ের নাম অনুসারে এ অঞ্চলের নাম হয়েছে চাঁদপুর। অন্যমতে, চাঁদপুর শহরের (কোড়ালিয়া) পুরিন্দপুর মহল্লার চাঁদ ফকিরের নাম অনুসারে এ অঞ্চলের নাম চাঁদপুর। ১৯৮৪ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারি চাঁদপুর জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। নৌ-পথে ঢাকা থেকে চাঁদপুর যেতে সময় লাগে ৩/৪ ঘন্টা।


চাঁদপুর জেলার উত্তরে মুন্সিগঞ্জ ও কুমিল্লা জেলা, দক্ষিণে নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও বরিশাল জেলা পূর্বে কুমিল্লা জেলা এবং পশ্চিমে মেঘনা নদী,শরিয়তপুর ও মুন্সিগঞ্জ জেলা অবস্থিত।


টুরের বিবরনঃ


খুব ট্যুর দিতে ইচ্ছে করছে? হাতে টাকা পয়সাও কম? সময়ও কম? তাহলে আপনার শর্ট ট্যুরের লিস্টে চাঁদপুর শহর মোটামুটি একটা যায়গা করে নিতে পারে। এক দিনের ট্যুর হিসেবে যায়গাটা খারাপ না।


সকাল সকাল চলে যান সদরঘাট। গিয়ে সরাসরি চাঁদপুরের একটা লঞ্চে উঠে পড়ুন।প্রথম লঞ্চ ছাড়ে সকাল ৬:০০ এ। এর কিছুক্ষণ পর পরই একটা করে লঞ্চ ছাড়ে। লঞ্চ ভাড়া ১০০-৮০০ টাকার মধ্যে কোয়ালিটির উপর ডিপেন্ড করে। ১০০ টাকা দিয়ে ডেকের টিকিট কেটে নিলে টাকাও বাঁচবে আর রেলিং এর ধারে ভর দিয়ে দুই পাশের অসাধারণ দৃশ্যটাও উপভোগ করতে পারবেন। তবে এক্ষেত্রে বসার যায়গার অভাবে চাঁদপুর পৌছাতে পৌছাতে আপনার পা দুখানি সুস্থ নাও থাকতে পারে। তাই ১৫০ টাকা দিয়ে চেয়ার কোচে চলে যাবেন। অন্তত একটা বিশ্রাম নেওয়ার যায়গা পাবেন। 




পথে খাবারের জন্য সবচেয়ে ভালো হয় বাসা থেকে খেয়ে বেরোলে। আর যদি পুরোটাই বাইরে খাওয়ার ইচ্ছে থাকে তাহলে হোটেলে খাবার সেরে নিতে পারেন। লঞ্চের ক্যান্টিনের খাবার এড়িয়ে যাওয়া উত্তম কারণ অতিরিক্ত দাম রাখে তারা। চাইল বাহির থেকে খাবার নিয়ে বাহিরের দৃশ্য দেখতে দেখতেও খেতে পারেন। লঞ্চ জার্নি তো, যা খাবেন তাই ভালো লাগবে।


চাঁদপুর পৌছানোর পরঃ


পৌছাতে তিন থেকে সাড়ে তিন ঘন্টা লাগবে। লঞ্চ থেকে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে পড়ুন। ঘাট থেকে শিডিউলটা জেনে তারপর বের হবেন। বের হয়ে একটা অটো নিয়ে চলে যান বড় স্টেশনে। অটো ভাড়া ১০ টাকা। নামিয়ে দেবে পর্যটন কেন্দ্রের সামনে। যায়গাটা এখনো নির্মানাধীন। তবে শেষ হয়ে গেলে মোটামুটি সুন্দর একটা যায়গা হবে। ওখানে চটপটি, ফুসকা, মুড়ি পাবেন হালকা নাস্তার জন্য। অন্যগুলোর কথা জানি না, মুড়িটা মারাত্মক লেগেছে। হয়তো পেটে ক্ষিদে ছিল তাই। বসে আড্ডা দেওয়ার মত ভালো একটা যায়গা জেলা পর্যটন কেন্দ্র। অনায়াসে এক দেড় ঘন্টা কাটিয়ে উঠা যায়।


এবার আপনার পেট চোঁ চোঁ করবে। ভাববেন অনেক তো হালকা নাস্তা করা হলো, এবার একটু পেটপুজো হোক পুরোদমে। স্বাভাবিকভাবেই ভাতের হোটেলে যাবেন। গিয়ে ভাত আর মাছ পাবেন। ইলিশ মাছ ভাজা আর নদীর ছোট মাছের তরকারি। আলুভর্তা আর ডাল দিয়ে খাবেন। অনেক ভালো লাগবে। এক পিস মাছের দাম পড়বে ৬০-৮০ টাকা। জনপ্রতি ২০০-২৫০ এর মধ্যে বেশ ভালো খেতে পারবেন।





এ কাজটি তখনই করতে পারেন যখন আপনারা সর্বোচ্চ দুইজন থাকবেন। এর বেশি যদি হয় তাহলে আরেক কাজ করতে পারেন। পর্যটন কেন্দ্র থেকে বের হয়ে রেল স্টেশনের দিকে হাঁটা দিন। ৩-৪ মিনিট হাঁটলেই পৌছে যাবেন। রেল ফ্যান হলে কিছুক্ষন ট্রেন দেখতে পারেন। কিন্তু আপনার টার্গেট হলো স্টেশনের উলটো পাশে মাছের আড়ত। যাবেন, আর দেখবেন ইলিশের বাহার। দামও ঢাকার তুলনায় কম। সঙ্গে মানুষের সংখ্যার উপর ভিত্তি করে ইলিশ মাছ কিনে ফেলুন। আমরা ছিলাম চারজন। মাঝারি সাইজের একটা ইলিশ নিয়েছিলাম ৪০০/- দিয়ে। মৌসুমে আরও কমে পাবেন। মাছ নিয়ে বেরিয়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক দেখায়। তা না করে চলে যান আরেকটু ভেতরে। দেখবেন কতগুলো ভাতের হোটেল। পছন্দ মত একটায় ঢুকে যান। গিয়ে মাছটা ধরিয়ে দিয়ে বলুন ভেজে দিতে। মাছের সাইজের উপর ডিপেন্ড করে ৮০-১৫০ টাকা পর্যন্ত মাছ প্রতি নিতে পারে।


আধা ঘন্টার মধ্যে আপনাকে মাছ রেডি করে সামনে দেবে। ধোয়া ওঠা গরম ভাত, আলুভর্তা আর ডাল দিয়ে যখন কবজি ডুবিয়ে খেতে থাকবেন, মনে হবে সত্যি, বাঙালী হওয়া স্বার্থক। সাথে যদি একটা পাবদা মাছের তরকারী থাকে তাহলে তো কথাই নেই। আমরা গিয়েছিলাম মনু মিয়ার হোটেলে। মাছ ভাজা সহ আমাদের বিল এসেছে মোট ৪০০/-।


মেইন কোর্স তো হলো। এবার ডেজার্ট। আরেকটা অটো নিয়ে চলে যান কালীবাড়ি। ভাড়া ৫/-। খুঁজুন বিখ্যাত "ওয়ান মিনিট" মিষ্টির দোকান। গিয়ে বলুন একটা আইসক্রিম দিতে। ৪০/- রাখবে। এটার এভালুয়েশন আপনাদের উপরই ছেড়ে দিলাম। সব কিছু বলে দিতে নেই।


হাতে সময় থাকলে চাইলে বড় স্টেশনে এসে আড্ডা দিতে পারেন নাহলে লঞ্চ ঘাটে গিয়ে ঢাকায় ব্যাক করার ধান্দা করতে পারেন।


চাদপুর কে নিয়ে একটি প্রামান্যচিত্র: 



খরচের পরিমানঃ


এভাবে মোটামুটি গোছের একটা শর্ট ট্যুর দিয়ে আসতে পারেন।এক এক জনের ৭০০/- এর মত খরচ হতে পারে, বা আরো কম করতে চাইলেও কোন সমস্যা হবে না। কম খরচে অসাধারন একটা ডে টুর।


যাতায়াত ব্যাবস্থাঃ


যাওয়া আসার জন্য এম ভি সোনার তরী, রফরফ, আল বোরাক, ময়ূর ব্যবহার করতে পারেন। সবগুলোর ভাড়া মোটামুটি একরকমই


বর্তমানে সকাল ৬ টা থেকেই লঞ্চ আছে আর পরবর্তী লঞ্চ ৭.২০ এ সোনারতরী। এরপর ৮.০০, ৮.৩৫, ৯.১৫, ৯.৫০, ১০.৫০, ১১.৪৫ থেকে রাত ১২.৩০ পর্যন্ত নির্ধারিত সময়েই ছাড়ে।


যারা সকালে গিয়ে বিকালে ফিরতে চান, বিকালে ৩.৪০, ৫.০০, বা সন্ধ্যা ৬.০০ ও ৭.০০ এর লঞ্চে ফিরতে পারেন।


ভাড়ার পরিমানঃ


ডেক ভাড়া -১০০,

চেয়ার নন এসি -১৫০

কেবিন ননএসি সিঙ্গেল ৪০০-৫০০ 

ডাবল -৮০০


চাদপুরের আরো কিছু দর্শনীয় স্থান হলোঃ


প্রাকৃতিক শোভায় সুশোভিত চাঁদপুর জেলায় রয়েছে বহু দৃষ্টিনন্দন স্থান। এসব স্থান সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত কিছু বর্ণনা উপস্থাপন করা হল- 


চাঁদপুরের দর্শনীয় স্থান গুলোর মধ্যে হাজীগঞ্জ ও পূরানবাজারের ঐতিহাসিক জামে মসজিদ ও মেঘনা পাড়ের সূর্যাস্তের দৃশ্য অন্যতম। প্রাচীন কীর্তিগুলোর মধ্যে যে সব রয়েছে তা হলোঃ


১. ফরিদগঞ্জের সাহেবগঞ্জের নীলকুঠির ধ্বংসাবশেষ, 

২. মতলবের কালী মন্দির, 

৩. লোহাগড়ের সাতগুম্বুজ মঠ, 

৪. মেহেরের কালীবাড়ী, রাস্তি শাহ্ এ দরগাহ, 

৫. নাওড়ার মঠ, 

৬. সাচারের রথ, 

৭. উজারী বেহুলার শিলা, 

৮. নাসির কোট এর ধ্বংসাবশেষ, 

৯. মতলবের বেলতলীর সোলেমান শাহ লেংটা পাগলার মাজার। 

১০. রুপসা জমিদার বাড়ি


এছাড়া কচুয়া মনসা মুড়া, সাহার পাড়ের দীঘি। চাঁদপুর শহরে অবস্থিত স্বাধীনতা স্মারক ভাষ্কর্য ‘অঙ্গীকার’ এবং চাঁদপুরের ঐতিহ্য সম্বলিত ‘শপথ’ ভাষ্কর্য দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যকীর্তি। এছাড়াও রয়েছে প্রাকৃতিক প্রতিকুলতার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক উন্নয়নের নিমিত্ত চাঁদপুর জেলার কৃষি নির্ভর জনগণের আশার আলো ও সরকারের উন্নয়ন প্রচেষ্টার স্বাক্ষরবহনকারী দুটি ব্যয় বহুল প্রকল্প মেঘনা- ধনাগোদা সেচ প্রকল্প ও চাঁদপুর সেচ প্রকল্প জাতীয় ভিত্তিক দুটি গবেষনা প্রতিষ্ঠান মাৎস্য গবেষনা ইনষ্টিটিউট এবং আইসিডিডিআরবি চাঁদপুরের ভৌগলিক চাহিদা ও গুরুত্বের প্রতিভূ।



বর্তমানে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের প্রবেশদ্বারে নির্মাণের চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নাম সম্বলিত স্মৃতি ফলক এবং ট্রাক রোডে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে চাঁদপুরের প্রথম শহীদ কালাম-খালেক-শুশীল-শংকর সহ অন্যান্য সকল শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মারণে নির্মিত মুক্তিসৌধ আগামী দিনগুলোতে দর্শণীয় স্থান হিসেবে পরিচিতি পাবে।


চাঁদপুরকে নিয়ে আরো দুইটি প্রামাণ্যচিত্র দেখুনঃ




কৃষি ব্যাক্তিত্ত সাইখ সিরাজের করা একটি প্রামান্যচিত্রঃ 





ঢাকার কাছেই কম টাকায় দলবলে বা সাথে করে কোন বন্ধুকে নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন ইলিশের দেশে। নৌবা ভ্রমন হবে, নদী দেখবেন তাও তিনটা একসাথে, সাথে থাকবে ইলিশ আর ফিততি পথে আপনি যদি চান ট্রেনে আসবেন সেটাও করতে পারবেন। আর লন্চে করে আসলে আসতে পারেন, যদি সেটা চাদনী রাত হয় তাহলে তো কথাই নাই। সন্ধায় রওনা হলে রাত ১০ টার আগেই আপনি ঢাকায় আপনার বাসায়।


সতর্কতাঃ চাঁদপুর গেলে খুব জরুরি না হলে রিকশায় না ওঠাই ভালো। কারণ রিকশা ভাড়াটা বড্ড বেশি! তবে এখানে লোকাল ট্রান্সপোর্ট হিসেবে সিএনজি চালিত অটোরিক্সা বেশ ভালো।


সম্পাদনায়ঃ তানভীর মেহেদী

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ