ইতিহাসের ভয়ংকর ঠগি বাহিনি



ইতিহাসের ভয়ংকর ঠগি বাহিনি


বিশেষ শ্রেণীর দস্যুদল যারা পথিকের গলায় রুমাল বা কাপড়জড়িয়ে হত্যা করত। ঠগিরা ১৩ থেকে ১৯ শতকে বাংলা এবং উত্তর ভারতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। তারা হিন্দুদের দেবীকালীরপূজা করত। তাদের কথা প্রথম জানা যায় ১৩৫৬ সালে ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দীন বারানি লিখিত ‘ফিরোজ শাহর ইতিহাস’ গ্রন্থে। 


১৮৩০ সালে গর্ভনর জেনারেল লর্ড বেন্টিক ভারতে প্রশাসক উইলিয়াম হেনরি শ্লীম্যানকে ঠগিদের নির্মূল করতে নির্দেশ দেন। হেনরি শ্লীম্যান কয়েক বছরের চেষ্টার ফলে ঠগিদের নির্মূল করতে সমর্থ হন। কিছু হিসেব অনুযায়ী ১৭৪০ সাল থেকে ১৮৪০ সাল পর্যন্ত ঠগিরা ১ মিলিয়ন এর বেশি মানুষ হত্যা করেছিল!


ঠগিরা সাধারণত দলগতভাবে ব্যবসায়ী, তীর্থযাত্রীর কিংবা সৈন্যের ছদ্মবেশে ভ্রমণ করত এবং পথিমধ্যে অন্য তীর্থযাত্রীদের সাথে ভাল ব্যবহার করে তাদের সাথে মিশে যেত। তারপর তারা হঠাৎ করেই কোন যাত্রাবিরতিতে ভ্রমণকারীদের গলায় হলুদ রং এর কাপড় পেঁচিয়ে হত্যা করত। তাদের সম্পত্তি লুঠ করে মৃতদেহগুলোকে তারা হিন্দু দেবীকালীরনামে উৎসর্গ করত। হত্যার পর মৃতদেহগুলোকে একসাথে হাড় ভেঙ্গে কবর দিয়ে রাখত যাতে পচন প্রক্রিয়াটি ত্বরান্বিত হয়।


ঠগি শব্দটি সংস্কৃতঠগশব্দ থেকে এসেছে। ঠগ অর্থ- ঠক বা প্রতারক বা ধূর্ত বা প্রবঞ্চক। ভারত শাসনের সময় যেসব শব্দ ইংরেজি ভাষায় যুক্ত হয়েছে "থাগ" তাদের মধ্যে অন্যতম। শব্দটির অর্থ চোর বা ডাকাত। "থাগ" শব্দটি সংস্কৃত ঠগি শব্দ থেকে এসেছে। ১৮৩৯ সালেফিলিপ মেডোউস টেলরের উপন্যাস "কনফেসনস অফ অ্য থাগ" এর মাধ্যমে ঠগিদের কাহিনী জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং একই সাথে "থাগ" শব্দটি ইংরেজি ভাষায় যুক্ত হয়ে যায়। এই ধরনের হত্যাকান্ডের গল্প দক্ষিণ এশিয়া তথা ভারতে জনপ্রিয় ছিল।


ঠগিরা সাধারনত বংশপরম্পরায় এই হত্যাকান্ড ঘটাত। একজন ঠগি বালক ১৮ বছর হলে সে হত্যার অনুমতি পেত। ১৮১২ সালে ব্রিটিশ সরকার ঠগিদের কথা প্রথম জানতে পারে। সেসময় একটি গণকবরে ৫০টি মৃতদেহ গলায় ফাঁস দিয়ে হত্যা করা অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। ঠগিরা তাদের দেবীকে বাংলায় ভবানী নামে ডাকত। তারা সাধারনত বছরের এক সময় ঘর সংসার করত এবং শরৎকালে দলগত ভাবে যাত্রা করত মানুষ হত্যার জন্য। ঠগিরা দলের সর্দারকে জমাদার নামে অভিহিত করত। ঠগিদের প্রধান তীর্থক্ষেত্র ছিল পশ্চিমবাংলার ’কালীঘাট’ ও বিন্ধ্যাচলের ’ভবানী মন্দির’।


ঠগিরা হত্যাকান্ডের জন্য একটি হলুদ রংএর রুমাল ব্যবহার করত যার র্দৈঘ্য ছিল মাত্র ৩০ ইঞি। রুমালটি ভাজ করে তার দুই মাথায় দুটি রুপার মুদ্রা দিযে বেধে দিত। হত্যা সময় একজনকে হত্যার জন্য তিনজন ঠগি ছিল এদের একজন মাথা ঠেসে ধরত, একজন রুমালটি হত্যার শিকার ব্যাক্তির গলায় পেচিয়ে ধরত ও অরেকজন পা ধরে থাকত।ঠগিরা হত্যার পর লাশ গুলো মাটিতে পুতে ফেলত। কেউ পালিয়ে গেলে ঠগিদের অগ্রবর্তী দল তাদের হত্যা করত। তারা সাধারনত ভিক্ষুক, সংগীতজ্ঞ, নৃত্যশিল্পী, ঝাড়ুদার, তেল বিক্রেতা, কাঠমিস্ত্রি, কামার, বিকলাঙ্গ, কুষ্ঠরোগী, গঙ্গাজল বাহক ও নারীদের হত্যা করত না।


প্রথমদিকে কোন তীর্থযাত্রী নিখোঁজ হলে ব্রিটিশ শাষকরা এটাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মনে করত কিন্তু যখন আস্তে আস্তে ব্রিটিশরাও নিখোঁজ হওয়া শুরু করল তখন গর্ভনর জেনারেল লর্ড বেন্টিক জানতে পাড়েন এটাতে একটি ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের হাত রয়েছে। তখন তিনি ঠগীদের নির্মূল করতে ১৮৩০-এর সালে ভারতের প্রশাসক উইলিয়াম হেনরি শ্লীম্যানকে নির্দেশ দেন। হেনরি ঠগিদের নির্মুল করতে গুপ্তচর নিয়োগ করেন যাতে তাদের গতিবিধি সম্পর্কে আগেই আচ করা যায়। ১৮৩০ সাল থেকে ১৮৪১ সাল পর্যন্ত তিনি প্রায় ৩৭০০ ঠগিকে ধরতে সমর্থ হন। ১৯৪০ সালের দিকে প্রায় ৫০০ ঠগির ফাঁসি দেওয়ার পর ঠগিদের সংখ্যা কমে আসে। এখনো ভারতের রাজস্থানে ঠগিদের বংশধরদের দেখা যায় তবে তারা স্বাভাবিক জীবন যাপন করছে। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ