খালেদ মোশাররফ - One Man Army

খালেদ মোশাররফ - One Man Army


আমার ফ্রেন্ড সার্কেলের মধ্যে ওয়েস্টার্ন মুভির ভক্ত প্রচুর। প্রিয় নায়কের কথা জিজ্ঞেস করলে এক বাক্যে ক্লিন্ট ইস্টউড, এক বন্ধু আছে, প্রিয় নায়কের কথা উঠলেই ইস্টউডের গল্প শুরু করে। 


—চুরুট টানার স্টাইল দেখছস? এক হাতে চুরুট টানে আরেক হাতে পিস্তল ড্র করে।

—আমাদেরও এরকম একজন ছিল…

—কস কি ? কোন নায়ক?

—নায়ক না, বাস্তবেই…

—কে সে?

— মেজর খালেদ মোশাররফ, ক্র্যাক পাবলিক…


বেচারা বিশ্বাসই করতে চায় না যে আমাদেরও একজন ছিল। পাকিস্তানী সেনাদের সাথে তুমুল যুদ্ধ চলতেছে, নির্বিকারচিত্তে এক হাতে সিগারেট টানতে টানতে আরেকহাতে গুলি করতেছে খালেদ, যুদ্ধক্ষেত্রের খুব সাধারন দৃশ্য ছিল এইটা। একজন সেক্টর কমান্ডার নরমালি পিছনের তাবুতে বসে নিরাপদে যুদ্ধ পরিচালনা করে, খালেদ ছিল পুরাই উল্টা, নিজের হাতে স্টেনগান চালাইতে না পারলে সেইটারে যুদ্ধ বলে নাকি?


আজকালের আধুনিক প্রজন্মের হিরো জেমস বণ্ড, পিচ্চি ভাগনে প্রায়ই বন্ডের গল্প করে। মামা, মাইরগুলা দেখছ? কি ট্যালেন্ট এইরাম কমান্ডো হইতে পারলে আর কি লাগে।


পুরা দুনিয়া সামনে দাঁড়ায়া গেলেও ঠেকানো যায় না মানুষটারে। আরিব্বাপ্রে…বাপ.....


আমাদেরও একটা কমান্ডো ছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইতিহাসে সবচেয়ে দুর্ধর্ষ কমান্ডো ছিল সে। কমান্ডো ট্রেনিং শেষে তার সার্টিফিকেটে লেখা ছিল, “এই ব্যক্তি পৃথিবীর যে কোন দেশের, যে কোন সেনাবাহিনীর সঙ্গে, যে কোন অবস্থায়, অনায়াসে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে সক্ষম, যুদ্ধ করতে পারদর্শী”।


দেখতে সেই হ্যান্ডসাম ছিল, পাকিস্তান আর্মির কমান্ডো ট্রেনিং দিতে যখন গ্রাউন্ডে আসতো, পাকি অফিসারগুলো ফিসফিস করত, “লুক জেন্টলম্যান, দিস ইজ তাহের, আ লিজেন্ড ইন দ্য হিস্ট্রি অভ কামান্ডো ট্রেনিং। …আ ম্যান ক্যান নট বী আ তাহের। হী ইজ আ সুপার, এক্সেপশনাল’।” নতুন ক্যাডেটদের পাকি অফিসাররা সাবধান করে দিত, ‘ইয়াংম্যান, বী আ্যওয়ার অভ তাহের। হী ইজ আ ভলকানো, আ হানড্রেড পার্সেন্ট এক্সামপল, প্রফেশনাল। সো সেভ ইয়্যুর স্কীন’’


মানুষটা ছিল ক্র্যাক, ১১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার তাহের সবগুলা যুদ্ধে অস্ত্র হাতে বাঘের মত যুদ্ধ করছিল। সে কমান্ডার, বাহিনীর স্বার্থেই তার নিজেকে কিছুটা নিরাপদ রাখা লাগে। সে এইসবের ধার ধারলে তো কাজ হবে না। কামালপুর যুদ্ধক্ষেত্রে ভয়ংকর যুদ্ধ হইতেছে, মর্টার শেল আর মেশিঙ্গানের অবিরাম ঠা ঠা শব্দে বজ্রনিনাদ চারপাশে। হঠাৎ একটা গোলা এসে পড়ল তাহেরের সামনে। ধোঁয়া কেটে যাওয়ার পর দেখা গেল, কমান্ডারের একটা পা থেঁতলে দুই ভাগ হয়ে গেছে, শার্টটা খুলে পেচায়া বাঁধার পরেও দরদর করে রক্ত বের হইতেছে। আর এইদিকে অজ্ঞান হওয়ার বদলে পাগলের মত গর্জন করছে মানুষটা,, থরথর করে কাঁপতেছে আর ধমক দিতেছে , “আমার কিচ্ছু হয় নাই, ফ্রন্টে ফিরা যাও তোমরা,, যুদ্ধ চালায়ে যাও … আমি মরব না, যত তাড়াতাড়ি পারি ফিরা আসব তোমাদের কাছে… আমি যেন ফিরে এসে দেখি কামালপুর দখল হয়ে গেছে আর ঢাকার রাস্তা পরিস্কার…”


কুলনেস জিনিসটা, ক্র্যাক জিনিসটা দুই নাম্বার সেক্টরের যোদ্ধারা হাতে কলমে শিখত, শিক্ষক ছিল মেজর খালেদ মোশাররফ। মার্চের ২৬ তারিখেই ৪ঠ বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়া বিদ্রোহ করল মানুষটা, ঢাকায় যে তার বউ-বাচ্চা আছে, তাদের মেরে ফেলতে পারে, একটাবার ভাইবাও দেখল না। পুরাই তারছিঁড়া ছিল, ঢাকা থেকে ট্রেনিং নিতে আসা ১৮-২০ বছর বয়সের হাজার হাজার পোলাপানরে সে আর ক্যাপ্টেন হায়দার মিলা গেরিলাযুদ্ধের ট্রেনিং দিছিল, বারুদ বানায়া দিছিল একেবারে। একটুও ভয়-ডর ছিল না ওদের, জানের মায়া ছিল না, চোখের পলকে এসএমজি বাইর কইরা ট্রেইনড পাকি আর্মিরে ব্রাশফায়ার করত পোলাগুলা, হিট অ্যান্ড রান শেষে মিনিটের মধ্যে আবার সব ভদ্র।


২৩শে অক্টোবর কুমিল্লা অঞ্চলে প্রচণ্ড যুদ্ধ চলতেছে, এক হাতে স্টেনগান আরেক হাতে সিগারেট, গুলি করতে করতে অর্ডারও দিতেছে , এমন সময় পাকিস্তানী মর্টার শেল… অসংখ্য স্পিন্টার ঢুকল মাথায়, রক্তে ভেসে যাইতেছে চারপাশ, তৎক্ষণাৎ হাসপাতালে নেওয়া হইল। এই অবস্থায় কেউ বাঁচতে পারে না, বাচা সম্ভব না। মেডিকেল সায়েন্সের আশ্চর্যতম মিরাকেল হয়ে বেঁচে উঠলো খালেদ, মাথার ভিতর তখন পাকি মর্টারের স্পিন্টার…


নভেম্বর মাসটা একগাদা আফসোস আর আক্ষেপ নিয়ে আসে। যদি তাহের আরেকটু ধৈর্য ধরতো, যদি খালেদকে প্রতিপক্ষ না বানায়ে একসাথে কাজ করত, যদি খালেদ আরেকটু কঠোর হইতে পারত, যদি মুজিব হত্যার সাথে সংশ্লিষ্ট সবাইরে ৩ তারিখেই ফাঁসি দিয়ে দিত, যদি তাহের জিয়াকে মুক্ত না করত, যদি তাহের একজন পাকিস্তানীকে বিশ্বাস না করত…


পহেলা নভেম্বর মেজর খালেদের জন্মদিন। ১৪ই নভেম্বর কর্নেল আবু তাহেরের। স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর খালেদ আর তাহেরের জন্মদিনের অনুষ্ঠানটা জাতীয়ভাবে পালনের কথা ছিল, নতুন প্রজন্মের অসংখ্য তরুন-যুবাদের আসার কথা ছিল। অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলতে উঠে হয়তো তাহের বলত দুই ভাগ হয়ে যাওয়া পা নিয়ে মিত্রবাহিনীর উদ্ধারকারী অফিসারকে হাসতে হাসতে বলা সেই অসামান্য উক্তি, ‘এরা কী যুদ্ধ করবে, এরা আমার মাথায়ই গুলি লাগাতে পারেনি। 


বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই, এরা আটকাতে পারবে না, এদের এই ক্ষমতাই নাই। খালেদ বলত কিছু তারছিঁড়া ছেলেপেলের কথা, “ আমি তাদের বলছিলাম ঢাকার আশে পাশে বোমা ফাটায়ে আসতে, তারা ইন্টারকন্টিনেন্টালের ভিতরেই ফাটায়ে আসছে। দিজ আর অল ক্র্যাক পিপল” বলার সময় হয়তো খালেদের চোখ দুটো চিকচিক করে উঠত, একটা আশ্চর্য গর্ব ফুটে উঠত চোখে… মাই বয়েজ…


২য় বিশ্বযুদ্ধের ৬০ বছর পার হয়ে গেছে, এখনো নাৎসি বাহিনীর নৃশংসতা আর মিত্রবাহিনীর বীরদের নিয়ে একের পর এক অসামান্য মুভি তৈরি হচ্ছে। একটা মুভি কেবল একটা মুভিই না, ইতিহাসকে ধরে রাখা, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বীরত্বগাঁথা ছড়িয়ে দেবার সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম।


৪৩ বছর পর আজো আমাদের খালেদকে নিয়ে কোন মুভি হল না, তাহেরকে নিয়ে কোন মুভি হল না। মুভি তো দূরের কথা, আধুনিক প্রজন্মের আপডেটেড ছেলেমেয়েদের এইটা নিয়া জানারও বিন্দুমাত্র আগ্রহ নাই। প্রজন্মের কাছে একাত্তর গণ্ডগোল মাত্র, একাত্তরের অসামান্য বীরত্বগাঁথা পুরাতন ইতিহাস, বীরযোদ্ধারা ব্যাকডেটেড অতীতমাত্র। প্রজন্ম খুবই স্বাস্থ্যসচেতন, কে যায় ঘাঁটাঘাঁটি করতে পুরান ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি করতে? পুরান জিনিস ঘাঁটাঘাঁটি বড়ই আনহাইজেনিক যে…


আহারে বাঙলা মায়ের বীর সন্তানেরা, আহারে…

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ