![]() |
তানভীর মেহেদী (সাব ইন্সপেক্টর) |
তানভীর মেহেদীঃ সারা বিশ্বে চলছে মহামারি ও প্রাণঘাতি করোনা ভাইরাস এর প্রকোপ। এই ভাইরাসের শুরুটা হয়েছে চিনের উহান প্রদেশ থেকে। শুরু হওয়ার পর থেকেই আমরা বাঙালিরা এটাকে নিয়ে আলাপ আলোচনা হাসি মজা আর চিনারা কি খায় না খায় এসব নিয়া জল্পনা কল্পনা করা শুরু করে দেই। আমাদের দেশের হট টপিক হয়ে যায় এটা, খবরের চ্যানেল থেকে শুরু করে হুজুরদের ওয়াজ মাহফিল সব খানে শুধু করোনা ভাইরাস নিয়ে আলোচনা সমালোচনা। এর ভয়াবহতা নিয়ে এখনো আমাদের মাঝে তেমন কোন হেলদোল নেই। কেউ কেউ বলছি এটা চীনেই শেষ হবে, ওরা অনেক পাপি ওদের উপর গজব নাজিল হইছে আল্লাহর, কিন্তু আমরা ভুলে গেছি ওরা পাপি বান্দা কিন্তু আমরা কি এমন আমল করতেছি যে গজব আমাদের উপর আসবে না।
শুরুতে অনেক হুজুর এটা গ্যাড়ান্টি সহকারে আমাদের উপর আসবে না বলে ভরষা দিয়েছিলেন, আমাদের সরকার ও বলেছিলো আমরা করোনাকে দেখে নিব, এটার চামরা দিয়ে ডুগডুগি বানায়া নববর্ষের মিছিলে বাজাবো। কিন্তু এটাকে দেশে আসতে না দেওয়ার বা আসলে কি করা হবে তার কোন ব্যাবস্থা নেওয়া হচ্ছেনা তখনো।
হঠাৎ করে চীন থেকে উহানে পড়তে যাওয়া কিছু বাঙালি ছাত্র হাউমাউ করে কান্নাকাটি শুরু করলো, তাদেরকে দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে নইলে তাদের প্রাণটা যাবে। বাংলাদেশ সরকার মায়া করে ভালোবেসে তাদের কিছুদিন পর ফিরিয়ে আনলো। ছাত্র সবাই, বিদেশে পড়তে গেছে, সবাই সব বুঝে, তাদের ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে রাখা হলো, তারা ভালো ছেলের মতো সেখানে ১৪ দিন বন্দি হয়ে থাকলো হজ্জ ক্যাম্পে। তাদের দ্বারা দেশের কোন বিপদ তখনো শুরু হয়নাই। দেশ এখনো করোনা মুক্ত।
সারা বিশ্ব যখন করোনার ভয়ে বিমানবন্দর সমুহ বন্ধ করে দিলো, সব প্রবেশ মুখে তালা দিল তখন বাঙালিরা মুখ হা করে বসে থাকলো কবে করোনা এসে মুখে ঠুকবে। করোনার স্বাদ তিতা না মিঠা এটা জানাটাও তো জরুরি। এদিকে ইটালিতে করোনা অনেক বেশি যুদ্ধ শুরু করে দিছে, প্রতিদিন ৭০০/৮০০ মানুষ মারা যাচ্ছে। সেখানে থাকা বাঙালিরা কান্নাকাটি শুরু করে হুরমুর করে দেশর বিমানে উঠে ফুরুৎ করে ঢাকা চলে আসছে। যেখানে সব দেশ বন্ধ করে দিছে সেখানে আমরা করোনা ভর্তি মানুষ আমদানি করতে ব্যাস্ত দেশের বাজারে, কারন তারা রেমিট্যান্স যুদ্ধা, দেশে কুটি টাকা পাঠায় তারা।
এত মানুষ বিদেশ থেকে আসলো যে তাদের কে আর ধরে রাখা গেলো না, কিসের আইসোলেশন কিসের কোয়ারেন্টাইন, সব কিছু ভেংগে চুরে সবাই বিমান বন্দর ফাকা করে বাড়ি গিয়ে বৌ এর হাতের কালা ভুনা খেতে লাগল, কেউ কেউ শশুর বাড়ির রসের হাড়ির স্বাদ নিতে দৌড়ালো, আবার কেউ মেয়ে বন্ধুকে এতদিন পর কাছে পেয়ে মটর বাইকের পিছনে বসিয়ে ধুম্মা চালে করে রাইড দিতে থাকলে। এই রসের সুযুগে করোনা আরো রসালো হয়ে বাঙালিদের উপর হামলে পরলো।
এবার করোনার স্বাদ তিতা সেটা বুঝতে পেরে সরকার লকডাউন এর ব্যাবস্থা করে বসলো। তখন আমি ঢাকায়, আম্মুকে ডাক্তার দেখাবো বলে এসেছি। আর কিছুদিনের ভিতর লকডাউন শুরু হবে, স্কুল কলেজ সহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। কিছুদিন পর হয়ত সব কিছু বন্ধ হয়ে যাবে। এরই ভিতর আমি আর আমার আম্মু মালিবাগ মৌচাক ঘুরে ঘুরে পুলিশ ট্রেনিং এ যাবার জন্য অনেক সপিং করে ফেললাম। টাকার হিসাবে সেটা ১২ হাজার টাকার মতো। সপিং করতে করতেই সন্ধায় শুনলাম আগামীকাল থেকে সব সপিং মল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষনা করা হয়েছে।
আগামীকাল থেকে লকডাউন শুরু হবে, সবাই ছুটছে বাড়ির দিকে। আমাদের তো বাড়ি যেতেই হবে, আমরাও ছুটলাম। সকাল সকাল সায়দাবাদ থেকে বাসে উঠে বাড়ি চলে আসলাম। শুরু হলো লকডাউন আর কোয়ারেন্টাইন। আর প্রতিদিন বাড়তে শুরু করলো রুগি আর মৃত্যুর মিছিল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ব্রিফিং শুনা ছিলো প্রতিদিনের প্রধান কাজ। প্রথম কিছুদিন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজি সেব্রিনা ফ্লোরা ব্রিফিং করলেও দেশের কিছু মানুষ ওনার শাড়ি গুনা শুরু করে দিলো। তারপর যখন উনি দেখলেন উনার শাড়ি গুনতে গুনতে ওরা ২৫/২৬ টা গুনে ফেলেছে, করোনা থেকে বাচতে কি করতে হবে তার চাইতে বড় হয়ে গেছে ফ্লোরা আপা আজ কি রকম শাড়ি পরলো তার হিসাব রাখা, তখন উনি মনের দিঃখে বা রাগে ব্রিফিং করাই বাদ দিলেন।
এই করে করে বাংলা নববর্ষ চলে গেলো, রমজান আসলো, আমরা সবাই বাড়িতে বসে বসে হাপিয়ে উঠলাম। আমার পুলিশ ট্রেনিং কবে শুরু হবে তার তো কোন খবর ই নাই। অবশেষে রমজান মাস শেষ হলো ঈদ আসলো, ঈদও শেষ হলো। সীমিত আকাড়ে লকডাউন তুলে নেওয়া হলো। সরকারি অফিস খুলা শুরু হলো। কিছু কিছু শিল্প কারখানাও শুরু হয়ে গেলো। করোনা আরো দ্বিগুন উৎসাহে ছড়িয়ে পড়া শুরু করলো। এখন দেশে প্রতিদিন ৩০০০ লোক আক্রান্ত হচ্ছে, ৩৫-৪০ জন রোজ মারা যাচ্ছে।
![]() |
তানভীর মেহেদী |
এমন সময় আমার খবর এলো, জুনের ১ তারিখ, যে আমাকে জুনের তিন তারিখ কুমিল্ল্ পুলিশ লাইন থাকতে হবে, আমাদের এসপি স্যার ব্রিফ করবেন সামনে কি করা হবে তা নিয়ে। আমার কপাল খারাপ শুরু হলো সেদিন থেকে। জুনের দুই তারিখ ব্যাগ গুছাচ্ছি, তিন তারিখ চলে যেতে হবে হয়ত তাই। ঠিক তখনি শরির গরম হয়ে মাথা ঘুরে জ্বর চলে আসলো। বুজলাম না কিসের জ্বর এটা। কিছুদিন আগে রোজ ক্রিকেট খেলতাম, সেটার কারনে জ্বর উঠলো নাকি ঠিক বুজলাম না। রাতের দিকে অবস্থা আরো খারাপ হলো, বমি হলো, জ্বর হলো। তারপর তিন তারিখ বিকালে অনেক কষ্ট করে বৃষ্টিতে ভিজে কুমিল্লা পুলিশ লাইন এসে উপস্থিত হলাম।
সেখানে হলা হলো ৮ জুন থেকে আমাদের হোটেলে উঠতে হবে। হোটেল ভাড়া করা হয়েছে, সেখানে আমাদের করোনা টেষ্ট করা হবে, যগি নেগেটিভ হয় তো ১৩ তারিখ সকালে রাজশাহী সারদা প্রেরন করা হবে, আর পজেটিভ হলে চিকিৎসা করে সুস্থ করা হবে তারপর প্রেরন করা হবে।
তারপর নুটিশে কিছুটা পরিবর্তন হলো, ৭ তারিখ বিকেলে বাড়ির সবাইকে বিদায় করে কুমিল্লার আলেখারচর বিশ্বরোডের ময়নামতি হোটেলের ২০৮ নাম্বার রুমে এসে উঠলাম। তারপর পর দিন সকালে প্রচুর বৃষ্টি। ৮ জুন, পুলিশের বাসে করে পুলিশ লাইন হসপিটালে গিয়ে সেম্পল দিয়ে আসলাম। তেমন কোন কঠিন কাজ না, গলার ভিতর থেকে কটন বার দিয়ে সেম্পল দিতে হয়। নিজেরটা নিজেই করলাম। তারপর আবার হোটেলে এসে রেজাল্ট এর জন্য অপেক্ষা করতে শুরু করলাম।
১১ জুন সকাল বেলা আমাদের ওসি সার, ডিআই ১ দরজার সামনে এসে হাজির। বলেন তোমার সেম্পল পাওয়া যায়নাই, তুমি একটু সেফ থাকো, গরম পানি টানি খাও। তখনি বুঝে গেছি করোনা পজেটিভ হয়ে গেছে। তারপর দিন রাতে কোতোয়ালি থানা থেকে ফোন করে বলল আমাদের ৪ জনের করোনা পজেটিভ বাকি ৪০ জনের নেগেটিভ। কি আর করবো, দুঃখের সাহরে পড়লাম।
১৩ জুন সকালে সবাই চলে গেলো বাসে করে রাজশাহী আর আমি করোনার সাথে যুদ্ধ করতে লাগলাম। শরির টাও খারাপ হতে শুরু করলো। জ্বর হলো হালকা, মাংস প্যাশি ব্যাথা হলো, মারাত্তক শারিরীক দুর্বলতা অনুভব করলাম। মাথা ঘুরাতে লাগলো, এর ভিতরেই চললো গরম পানি, লেবু, মাল্টা, আর মসলা চায়ের চিকিৎসা। সাথে পাওয়া গেলো পুলিশ লাইনের কিছু ঔষদ। তারপর ১৫ জুন আবার ২য় সেম্পল নিলো, আল্লাহর রহমতে এবার নেগেটিভ আসলো, তবে রেজাল্ট আসলো ২০ তারিখ৷ ৫ দিন সময় নিলো।
একবার নেগেটিভ হলে চলবে না, ২ বার নেগেটিভ হতে হবে, আমরা ২ জন নেগেটিভ হই ২য় বার আর বাকি ২ জন আবারো পজেটিভ হয়। তারপর ২৪ জুন আবারো ৩য় সেম্পল নেওয়া হয় আমাদের, সেটার ফলাফল এখনো আসে নি, আজ ২৮ জুন। জুনের ৭ তারিখ থেকে ২৮ জুন পর্যন্ত বন্দি আছি ছোট একটা রুমে, শুনছি রাজশাহী গেলে নাকি আরো ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইন থাকতে হবে। আল্লাহ জানে সামনে আরো কিকি আছে
0 মন্তব্যসমূহ
ধন্যবাদ আমাদের সাথে যোগাযোগ করার জন্য