আমি সাব ইন্সপেক্টর তানভীর মেহেদী।
এইতো কিছু দিন আগে পিএসআই মানে শিক্ষানবিশ পিরিয়ড শেষ করে চাকরিতে স্থায়ী হলাম। জুলাই
মাসের ১৯ তারিখে আমি আমার চাকরি জীবনের প্রথম পোষ্টিং নিয়ে যোগদান করলাম বাশখালী থানার
বাহারছড়া পুলিশ ফাড়ীতে। পুলিশে যোগদান করার পর মনে মনে একটি সাজানো গোছানো থানায় চাকরি
করবো বলে ভাবছিলাম, কিন্তু কপালে আর তা হলো না। আমার এসপি স্যার আমাকে কনফার্ম পোষ্টিং
দিলো এই দুর্গম আর উপকূলিয় ফাড়ীতে।
ফাড়ীটি বাশখালী থানার অধিনে একটি
পুলিশ ফাড়ী। এটি খানখানাবাদ এবং বাহারছড়া ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত একটি ফাড়ী। একটি বেসরকারি
সাইক্লোন সেন্টারের উপরে ফাড়িটি। সরকারি কোন বিল্ডিং নেই, থাকার কোন যায়গা নাই। অফিস
করার মতো কোন টেবিল নাই, দুতলার অগোছালো একটি গন রুমে সবাই থাকে। আমারো স্থান হলো সেখানে।
পরে বোঝলাম আমার চট্টগ্রাম জেলার সবচাইতে খারাপ পোষ্টিং টি আমার কপালে এসে পরেছে। এতে
আমার কোন দোষ না থাকলেও আমার কপালের কিছুটা দোষ ছিলো।
কপালের লিখা মেনে নিয়ে চাকরি শুরু
করলাম আমার ফাড়ীতে। ফাড়ীর চারিদিকে কোন জনবসতি নাই, চারদিকে খোলা মাঠ, হু হু করে বাতাস
আসছে সাগর থেকে। সারাদিন এলোমেলো বাতাসে ফাড়ীর জানালা কাপতেই থাকে। ফাড়ির আসেপাশে লোক
বসতি খুবই কম। ফাড়িতে কোন ধরনের পরিবহন ব্যাবস্থা নাই। এখানকার সিএসজি এসোসিয়েশন আমাদের
কে প্রতিদিন রাতে টহল দিবার জন্য একটি করে সিএনজি দেয়। সেটা দিয়েই আমরা রাতের টহল দিয়ে
থাকি। ঘটনা আমার এই রাতের টহল কে কেন্দ্র করেই।
আমি এমনিতে সাহসী ছেলে, ভুতে আমার বরাবরি কখনো তেমন কোন ভয় লাগে না ছোটবেলা থেকে। ছোটবেলায় আমার বয়সি ছেলে গুলি দেখতাম রাতে বাহিরে গেলে চোখ বন্ধ করে দৌড় দিত। আমার কখনো তেমন কলিজা উল্টানো ভয় কাজ করে না। অনেকবারি গ্রামের বাড়িতে আমার মনে হয়েছে আমার আশেপাশে কেউ আছে, বা অশরীরি কিছু আমার আশে পাশে আছে বলে মনে হচ্ছে এমন অনুভুমি আমি পেয়েছি। কিন্তু কখনো সাহস হারাই নি, আমার মতো আমি কাজ করে চলে এসেছি, কিন্তু এবার নাইট ডিউটি করতে গিয়ে আমি কিছুটা ভয়ের মোকাবেলা করতে হয়েছে।
আজ রাতের
সিরা নাইট ডিউটি ছিলো আমার উপর। আমি নতুন এখানে, এখানকার রাস্তা ঘাট এখনো আমার চিনা
হয়নাই। তাতে কোন তেমন সমস্য নাই আমার সাথে আমার ফোর্স আছে তারা কিছুটা হলেও রাস্তা
ঘাট চিনে। আমার তেমন কোন সমস্যা হয়না এখানে। আমি এর আগেও আরো কিছু নাইট এখানে করেছি
আমার তেমন কোন সমস্যা হয়নাই বা কোন ইমার্জেন্সি কল আমি পাইনাই। আজকের রাতে আকাশে কোন
চাদের আলো নাই। একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার একটা রাত। এখানে রাস্তা গুলিতে কোন আলোর ব্যাবস্থা
নাই। রাস্তার আশেপাশে তেমন কোন বাড়িও নাই আর থাকলেও সেগুলুতে তেমন কোন আলো থাকে না।
একেবারে অন্ধকার রাস্তায় সারা রাত ডিউটি করতে হয়। সিএনজির আলো ছারা আর কোন আলো থাকে
না কোথাও। এখানকার মানুষ গুলিও বেশি রাত সজাগ থাকে না, তারাতারি ঘুমিয়ে পরে খেয়েদেয়ে
আর যারা মাছ ধরার জন্য সাগরে যায় তারা সাগরে চলে যায়। এখানকার বেশিরভাগ যুবক শ্রেণী
সাগরেই থাকে মাছ ধরার জন্য। তেমন কোন ধরনের ঝামেলা হয়না আমার রাতে ডিউটি করতে।
ঘুটঘুটে
রাতের অন্ধকারে আমার গাড়ি চলতেছে। আমার কন্সটেবল গুলি গাড়িতে বসে বসে ঝিমুচ্ছে আর কেউ
ফোনে ফেসবুক দেখতেছে। একটু পর পর বাজার বা বড় কোন দোকানপাট দেখলে গাড়ি থামিয়ে হেটে
হেটে দেখতেছি আর সেখানকার প্রাইভেট সিকিউরিটি গার্ড গুলিকে সতর্ক করতেছি। তেমন কোন
লোকজন রাস্তায় নেই বললেই চলে। এখান আমার দুটি বড় বাজার আছে যা আমার জুরিডিকশান এলাকার
মধ্যে পরে। রাত একটার দিকে প্রথম বাজারটি দেখা শেষে পরের বাজারের দিকে ছুটে চলছে আমার
গাড়ি। বাতাসে শো শো শব্দ করে এগিয়ে চলছি আমরা। আমার রাস্তা টাও ভালোনা, ইটের সলিং রাস্তা
এখানে। প্রচুর ঝাকি লাগে ফলে এখানে গাড়িতে ঘুমানোর মতো কোন সুযুগ থাকে না।
এখানে
দেখলাম অনেক যায়গাতে রাস্তার পাশে গাছের সাথে গরু বা মহিষ বেধে রাথা হয়েছে। তার মানে
তাদের গরু চুরি হবার কোন ধরনের ভয় নাই। আমার হাতে খুব ভালো মানের একটা টর্চ লাইট আছে,
অনেক দূর পর্যন্ত সরাসরি এটার আলো চলে যায়। আমি মাঝে মাঝেই লাইট জেলে আসে পাশের সব
কিছু দেখছিলাম। কোথাও কোন সন্দহে জনক লোকজন বা জুয়া খেলার আসর নাকি দেখতেছিলাম। অন্ধকার
রাত গাড়ি চলছে, রাত বাজে দুইটা দশ মিনিটের মতো। হঠাৎ আমি খেয়াল করলাম আমার রাস্তার
সামনে গাড়ি থেকে অনেকটা দুরে একটা সাদা কাপর পড়া মহিলার মতো দেখা যাচ্ছে। গাড়ির আলোয়
সাদা অবয়বটা আরো প্রকট হয়ে আসতেছে। আরো কিছুটা কাছে আসার পর দেখলাম, একটা অনেক বৃদ্ধ
মহিলার মতো একটা মানুষ, বয়সের ভারে একেবারে কুজু হয়ে গেছে, সোজা হয়ে হাটতে পারছে না,
কুজু হয়ে রাস্তার মাঝখান দিয়ে হেটে চলতেছে অনেক দ্রুত গতিতে। এত বৃদ্ধ বয়সে এত দ্রুত
হাটার কথানা এই রাতের বেলা।
গাড়ির
আলোয় ভালো দেখা যাচ্ছিলো না দেখে আমি মহিলাটির গায়ের উপর টর্চ এর আলো ফেলতেই আরো ভালো
করে দেখলাম একদম বৃদ্ধ একটি মহিলা, কুজু হয়ে দৌড়ে চলছে রাস্তার উপরে। আমার সারা গায়ের
পশম দাড়িয়ে গেলো সাথে সাথে। আমি ড্রাইভারকে বললাম এক ফোটাও থামানো যাবে না, সোজা সাইড
দিয়ে গাড়ি টেনে বের হয়ে যেতে হবে। রাস্তা এমনিতে চিকন, এত যায়গা নেই সইড কেটে বের হয়ে
যাবার মতো। আমি আবারো টর্চের আলো ফেলতেই মহিলাটি আমার দিকে উল্টো ঘুরে তাকালো, আমি
যা দেখলাম আমি নিজের চোখকেও বিশ্বাষ করাতে পারলাম না। এত বিদঘুটে একটা চেহারা, বড় বড়
চোখ, গালের চামরা গুলি ঝুলে পরেছে, নাক টা ভিষন চোখা আর মুখে এত বড় বড় দাত গুলি বের
করে আমাকে কি জেনো বলতেছে। মনে হচ্ছে আমি তার উপর কেনো আলো ফেললাম সেটার জন্য সে খুবি
বিরক্ত আমাকে গালাগালি করতেছে মনে হলো। এমনকি উল্টো ঘুরে আমার গাড়ির দিকে তেরে আসতে
লাগলো আর দাত বের করে বকতেছে। আমি চেহারাটা দেখে কেমন জানি ভয় পেয়ে গেলাম। আমার ড্রাইভার
বুড়িতে পাশ কাটিয়ে সাই করে বের হয়ে গলো পাশ কেটে।
আমি আরো
সাহস নিয়ে পিছনের দিকে তাকালাম কিন্তু সেই সাদা শাড়ি পড়া মহিলাটাকে আর দেখতে পেলাম
না। আমি আবার টর্চের আলো ফেলে সারা রাস্তা আলোকিত করে দিলাম তাও তাকে আর কোথাও দেখা
গেলো না। এত রাতে এত বৃদ্ধ মহিলা রাস্তায় দৌড়ানোর কথানা, বা লাইট ফেলায় গাড়ির দিকে
তেরে আসার কথানা। তাহলে এটা কি ছিলো। ভূত ছিলো কি??
তারপর
আর কোন সমস্যা হয়নাই কোথাও । ঘটনাটি বেশিক্ষন না এক মিনিটের মতো সময়ে ঘটে গেলেও ঘটনার
রেসটা অনেকদূর চলে গেলো। আমি সারা রাত ডিউটি শেষ করে এসে ঘুমিয়ে গেলাম আর ভাবতে লাগলাম
তাহলে কি আজ ভুতের সাথে দেখা হয়ে গেলো।
0 মন্তব্যসমূহ
ধন্যবাদ আমাদের সাথে যোগাযোগ করার জন্য